এদেশে ইংরেজ শাসনামল মূলতঃ দুইটি পর্বে বিভক্তঃ
ক. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী শাসনামল (১৭৬৫-১৮৫৭)
খ. ব্রিটিশ সরকারি শাসনামল (১৮৫৮-১৯৪৭)।
বক্সারের যুদ্ধের পর ১৭৬৫ সালে মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গভর্নর রবার্ট ক্লাইভের মধ্যে সম্পাদিত এলাহাবাদ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে চলে যায়। দেওয়ানি লাভের পর বাংলার নবাবকে বৃত্তিভোগীতে পরিণত করে রবার্ট ক্লাইভ দ্বৈতশাসন প্রবর্তন করেন। দ্বৈতশাসন ছিল একটি অদ্ভুত শাসন ব্যবস্থা। এই শাসন ব্যবস্থায় ক্লাইভ বাংলার নবাবের উপর শাসন ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং রাজস্ব আদায় ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত করেন কোম্পানির উপর। এর ফলে নবাব পেলেন ক্ষমতাহীন দায়িত্ব আর কোম্পানি লাভ করলো দায়িত্বহীন ক্ষমতা ।
দ্বৈতশাসন ছিল এদেশের মানুষের জন্য এক চরম অভিশাপ। রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পেয়ে ইংরেজরা প্রজাদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে তা আদায়ে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। কোম্পানি এবং এর কর্মচারীদের অর্থের লালসা দিন দিন বাড়তে থাকে। অতিরিক্ত করের চাপে যখন জনগণ ও কৃষকের নাভিশ্বাস উঠার অবস্থা সে সময় দেশে পর পর তিন বছর অনাবৃষ্টির ফলে খরায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৭৭০ (বাংলা ১১৭৬) সালে বাংলায় নেমে আসে দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া। দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ লোক অনাহারে মারা গেলেও কোম্পানি করের বোঝা কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেয় নি। এই দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোকের মৃত্যু হয়েছিল । ইতিহাসে এটি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত।
১৭৭৩ সালের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নরদের পদবি হয়ে যায় গভর্নর জেনারেল। কয়েকজন উল্লেখযোগ্য গভর্নর জেনারেল হলেন ওয়ারেন হেস্টিংস, লর্ড কর্নওয়ালিস, লর্ড ওয়েলেসলি, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, লর্ড হার্ডিঞ্জ, লর্ড ডালহৌসি প্রমুখ। ভারতবর্ষে ইংরেজ সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে তারা ডাক ও তার এবং রেল যোগাযোগ স্থাপনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ।
ইংরেজ শাসকদের গৃহীত প্রধান প্রধান কাজ নিচে উল্লেখ করা হলো—
১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত ভারত শাসন আইনে বাংলায় ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের হাতে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা অর্পণ করা হয় ।
২.১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে ব্রিটিশদের অনুগত জমিদার শ্রেণি তৈরি করা হয়।
৩. রাষ্ট্র ও প্রশাসন পরিচালনায় ইংরেজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয় ।
৪. মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তর, শিক্ষা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করে এটিকে গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে রূপান্তর করা হয়। ১৭৭২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতাকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ঘোষণা করেন।
তবে কোম্পানী শাসনামলে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক ও লর্ড হার্ডিঞ্জ এদেশে শিক্ষা বিস্তারসহ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সূচনা করেন। এ ছাড়া সতীদাহ প্রথা ও বাল্যবিবাহ রোধ এবং বিধবা বিবাহ প্রবর্তনসহ সামাজিক কুপ্রথা নিবারণে রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো বাঙালিদের উদ্যোগকে তারা সহযোগিতা দেন। এভাবে দেশে একটি নতুন শিক্ষিত শ্রেণি ও নাগরিক সমাজ গড়ে উঠলেও বৃহত্তর বাঙালি সমাজ ইংরেজ কোম্পানির শাসনে প্রকৃতপক্ষে শোষিত হয়েছে।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দখল পেয়েই ক্ষান্ত ছিল না। দিল্লিতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল সাম্রাজ্যে বিভিন্ন সংকট দেখা দেয়। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছোটোবড়ো নবাব ও দেশীয় রাজারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এর ফলে দিল্লির মসনদও দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে কোম্পানির সেনাবাহিনী নানা দিকে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে।
১৮৫৭ সালে কোম্পানি শাসনের প্রায় একশ বছর পরে ইংরেজ অধ্যুষিত ভারতের বিভিন্ন ব্যারাকে সিপাহিদের মধ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু উন্নত অস্ত্র ও দক্ষ সেনাবাহিনীর সাথে চাতুর্য ও নিষ্ঠুরতার যোগ ঘটিয়ে ইংরেজরা এ বিদ্রোহ দমন করে। এরপর ১৮৫৮ সালের ২রা আগস্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত শাসন আইন পাস হয়, যার মধ্য দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে। ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারতের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করে। ভারত শাসন আইনের ফলে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা কর্তৃক একজন মন্ত্রীকে ভারতসচিব পদে (Secretary of State for India) মনোনীত করা হয় যিনি ১৫ সদস্যবিশিষ্ট পরামর্শক সভা বা কাউন্সিলের মাধ্যমে ভারত শাসনের ব্যবস্থা করবেন। এই আইন অনুসারে গভর্নর জেনারেলকে ভাইসরয় বা ব্রিটিশ রাজ প্রতিনিধি নামে অভিহিত করা হয়। লর্ড ক্যানিং প্রথম ভাইসরয় নিযুক্ত হন। এভাবেই ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৮৬১ সালে ভারত সরকারকে বাংলায় প্রতিনিধিত্বমূলক আইনপরিষদ স্থাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং বঙ্গীয় আইনপরিষদ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাও দেওয়া হয়। ১৮৬২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে বঙ্গীয় আইনপরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়। এর সদস্য সংখ্যা প্রথমে ১২ জন ছিল । ১৮৯২ সালে ২১ জন করা হয়। শুরুতে এই সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিধান ছিল না। পরে ভোটে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে এটি গড়ে উঠে এবং এ ধারাই বাংলাসহ সারা ভারতে প্রচলিত হয়। তবে আইনপরিষদের উপর ব্রিটিশ শাসকদের কর্তৃত্ব ঠিকই বহাল ছিল ।
ব্রিটিশ শাসনকালে (১৮৫৮-১৯৪৭) বাংলার সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল কৃষক, অন্যদিকে মুষ্টিমেয় জমিদার ছিল সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি। সমাজে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট ছিল না। বস্তুত ব্রিটিশ শাসনে বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষি ও এককালের সমৃদ্ধ তাঁতশিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। বাংলার বণিক গোষ্ঠী তেমন সংগঠিত ছিল না, শিল্পেও বাংলার অবস্থান তখন উল্লেখ করার মতো নয়। সামাজিক অনুশাসনের দাপটে নারীসমাজ ব্যাপকভাবে পিছিয়ে ছিল। মধ্যবিত্ত সমাজও ততটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে নি। ব্রিটেন ছিল সেই সময়ে পৃথিবীর প্রধান ধনী দেশ। গোটা ভারত ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ অর্থাৎ শোষণের ক্ষেত্র।
কাজ-১ : ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কী? ব্যাখ্যা করো ।
কাজ-২ : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে ভারত ইংরেজদের দ্বারা কীভাবে শাসিত হয়?
আরও দেখুন...